আসহাবে ফীল বা হস্তি বাহিনী
আবরাহার বিকল্প স্বর্ণ মন্দির নির্মাণ ও কা’বা গৃহ ধ্বংসের উদ্যোগঃ
আবিসিনিয়ার সম্রাট নজ্জাশীর সেনা নায়ক ‘‘আরবাত্ব’ যিনি সম্প্রতি ইয়ামান আক্রমণ করে তা আবিসিনিয়ার করতলগত করেছিলেন এবং অত্যাচার ও নির্যাতনের স্টীম রোলারে জনগণকে নিস্পেষিত করছিলেন। জনতা তার বিরুদ্ধে একটি গণ অভ্যুত্থান পরিচালনা করে আরবাত্বকে হত্যা করত : আবরাহা নিজেই ইয়ামানের শাসন ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন।
আবরাহা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর পরিকল্পনা করলেন যে বর্তমানে মক্কা যে গোটা আরব উপদ্বীপের মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় মর্যাদা ভোগ করছে তার বিলুপ্তি ঘটিয়ে ইয়ামানকেই ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ইয়ামানের ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত অনুকুলে ছিল। কিন্তু বাধ-সাজছে আর আর একটি বস্ত্ত। তা হলো মক্কায় কা’বা গৃহের অবস্থান। যা গোটা আরব দ্বীপের বাসিন্দাদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র একটি তীর্থস্থান বলে বিবেচিত। আবরাহা চিন্তা করল এর বিকল্প কিছু করা ব্যতীত তার পরিকল্পনা সফল হওয়ার নয়। সে প্রথমে কা’বা গৃহের আকারে আকৃতি ও নির্মাণ কৌশল সম্পর্কে খবর নিল। জানতে পারল যে তা একটি সাধামাটা পাথরের ঘর বৈ কিছুই নয়। এবার আবরাহার মনে এক বুদ্ধি আটল। সে ইয়ামানে স্বর্ণ-রৌপ্য ও মূল্যবান পাথর খচিত এক অনন্য সাধারণ মন্দির প্রতিষ্ঠা করল। এবং জনগণকে এ আহবান জানাল যে, তারা যেন তার এ স্বর্ণমন্দিরকেই তীর্থস্থান জ্ঞাত করে তথায় সমবেত হয়। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এর আকর্ষণীয় সৌন্দর্য ও অভিনব নির্মাণ কৌশলের কারণে তা অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, এবং লোকেরা মক্কার সাধামাটা প্রস্তর নির্মিত কা’বাকে বর্জন করবে। তার এহেন ঔদ্ধত্যপূর্ণ পরিকল্পনা আরবের স্বাধীনচেতা লোকদের আত্মসম্মান বোধকে চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করল। তাদেরই একজন ইয়ামানে গিয়ে আবরাহা নির্মিত স্বর্ণ মন্দিরের গায়ে ময়লা মেখে এল। এতে আবরাহা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, এবং প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠলো। সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল যে, মক্কার কা’বা গৃহকে ধ্বংস না করে সে ক্ষান্ত হবেনা। সে বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলো। সে মনে মনে ভাবতে লাগল এ বিরাট বাহিনীর মোকাবিলা করার সাহস তো আরবদের সম্মিলিত শক্তির পক্ষেও নাই। তাই সে অচিরেই কা’বা গৃহকে চূর্ণবিচুর্ণ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে। আর এভাবে তার স্বর্ণমন্দিরের প্রতি তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের সমুচিত শিক্ষা দিবে। আবরাহার এ বিশাল বাহিনী মক্কার অদূরে মুযদালিফার প্রান্তরে এসে উপনীত হল। হাজার হাজার সশস্ত্র সৈন্য ও শত সহস্র হাতির বিশাল বাহিনীর আগমনের কথা শুনে মক্কার লোকদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গেল। তারা বলাবলি করতে লাগল : এ বিপদ থেকে বাঁচার তো আপাতত কোনই উপায় দেখছিনা। তবুও চল আমরা ‘আব্দুল মুত্তালিবের সাথে পরামর্শ করি। তিনি প্রখর বিচক্ষণতার অধিকারী এক ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর মধ্যে এমন অলৌকিক শক্তি আমরা দেখতে পেয়েছি যা সাধারণত অন্য কারো মধ্যে দৃষ্ট হয় না। লোকেরা যখন ‘আব্দুল মুত্তালিবের বাড়িতে পৌঁছলো তখন জানতে পারল যে আবরাহা বাহিনী তার ২০০ উট ধরে নিয়ে গেছে, তাই তিনি সে ব্যাপারে আবরাহার সাথে আলাপ করতে গেছেন।
লোকেরা একথা শুনে বলাবলি করতে লাগল : যে লোক কা’বা গৃহ ধ্বংস করার জন্য এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কার দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁছেছে তার সাথে কোনরূপ দেন দরবার যে কাজে আসবে তা কি করে আশা করা যেতে পারে?
‘আব্দুল মুত্তারিব ঠিকই আবরাহার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। হস্তী বাহিনীর প্রধান আবরাহাকে খবর দিলেন যে, কুরাইশদের সর্দার তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। ‘আব্দুল মুত্তালিবের গুণাবলীও তার কাছে তুলে ধরলেন। তিনি বললেন : ইনি আরবদের অবিসম্বাদিত নেতা, সকলের মধ্যে মর্যাদার শীর্ষে, তার দানশীলতা সর্বজন বিদিত এবং সর্বক্ষণ তার মেহমান খানার দরজা উন্মুক্ত থাকে। আবরাহা অনুমতি দিলে ‘আব্দুল মুত্তালিব তার সাথে দেখা করার জন্য তার দরবারে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ‘আব্দুল মুত্তালিবক দেখেই তিনি সম্ভ্রমে অভিভূত হয়ে পড়লেন। এবং নিজের অজ্ঞাতসারেই সিংহাসন থেকে নেমে পড়ে বিছানায় বসে গেলেন। ‘আব্দুল মুত্তালিব গিয়ে তার পাশেই বসে পড়লেন। আবরাহা জানতে চাইলেন তাঁর আগমনের প্রধান উদ্দেশ্য কি?
‘আব্দুল মুত্তালিব অত্যন্ত ধীর ও শান্ত ভাবে উত্তর দিলেন : ‘‘আপনার সেনাবাহিনীর লোকেরা আমার ২০০ উষ্ট্র রাখালদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। আমি এগুলো ফেরত চাইতে এসেছি। ‘আব্দুল মুত্তালিবের একথা শুনে আবরাহা রীতিমত আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলেন।
তিনি ভাবতে লাগলেন, কুরাইশদের সর্দার আরবদের শ্রেষ্ঠ নেতা তার কাছে এসে নিজের উষ্ট্রগুলো ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করছেন, অথচ সংকটাপন্ন কা’বা গৃহ যা ধ্বংস করার জন্য তিনি বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কার দ্বার প্রান্তে এসে উপস্থিত সে বিষয়ে কিছুই বলছেন না। তিনি চরম ঔৎসুক্যের সাথে জিজ্ঞেস করলেন : ব্যাপার কি আপনি আমাকে আপনার উষ্ট্রগুলো ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করছেন আর যে কা’বা গৃহ ধ্বংস করতে এ বিরাট বাহিনী নিয়ে এসেছি সে বিষয়ে কিছুই বলছেন না?
‘তার কথায় ‘আব্দুল মুত্তালিব মৃদু হাসি দিয়ে বললেন : ‘‘উষ্ট্রের মালিক আমি নিজেই, তাই আমি আমার সম্পদ ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আনার সাথে দেন দরবার করছি। কা’বা গৃহের একজন অধিপতি আছেন। তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তাঁরই। তিনিই তা রক্ষার ব্যবস্থা করবেন।’’
আব্দুল মুত্তালিবের এ উত্তর শুনে আবরাহা রাগান্বিত হলেন এবং বললেন : আপনি এ কি বলছেন? এর একজন অধিপতি আছেন আর তিনিই তা রক্ষা করবেন। সে মালিক কে? কে আমার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে তা আমি দেখব।’’
‘আব্দুল মুত্তালিব মক্কা উপত্যাকার বাসিন্দাদের প্রতি এ মর্মে ঘোষণা জারী করলেন যে, সবাই যেন নিজেদের ঘরবাড়ি ত্যাগ করে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করে এবং আবরাহা বাহিনীর প্রতিরোধ করার কথা চিন্তা না করে। আর তিনি নিজে কা’বা গৃহের দিকে রওয়ানা দিলেন। সেখানে গিয়ে কা’বার দরজার চৌকাঠ ধরে নিম্নোক্ত কবিতাটি পাঠ করলেন :
‘‘একজন সাধারণ লোক পর্যন্ত তার কাফেলার উপর আপতিত যে কোন বিপদের মোকাবিলা করে, কাজেই হে মহামহীম প্রভু তোমার কাফেলা আজ শত্রু কবলিত, এদেরকে রক্ষা করার দায়িত্ব তোমারই।
আমি কোন দিন শুনিনি যে কোন নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর লোক পর্যন্ত তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কথা কল্পনা করেছে। অথচ এ আবরাহা তার দেশের জনগণকে নিয়ে একটি হস্তী বাহিনী সহকারে তোমরা ঘরের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
এরা অজ্ঞতা বশত: তোমার সংরক্ষিত অঞ্চলকে পদদলিত করার ষড়যন্ত্রে মেতেছে। অথচ তোমার পরাক্রম সম্পর্কে তারা অবহিত নয়।’’
এদিকে অবরাহা পরবর্তী দিন প্রত্যুষেই তার সেনাবাহিনীকে নির্দেশ ছিল হস্তী বাহিনীকে আগ্রভাগে রেখে যেন সম্মুখে অগ্রসর হয়। যাতে করে কুরাইশের লোকেরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। হাতী গুলোকে যতই মক্কার দিকে অগ্রসর করানোর চেষ্টা করা হয় তারা এককদমও এগোয়না, এমনকি বেদম প্রহারেও না। কিন্তু অন্য যে কোন দিকে যাত্রার নির্দেশ দিলে সাথে সাথে চলা আরম্ভ করে। আবরাহাকে এ বিষয়ে অবহিত করা হলে, তিনি অনন্যোপায় হয়ে হস্তী বাহিনীর আশা ত্যাগ করে পদাতিক অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। পদাতিক বাহিনী সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে যাচ্ছিল এমন সময় দেখা গেল যে, আকাশের গায়ে মেঘমালার মত কী যেন ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। অথচ আকাশে মেঘের কোনই সম্ভাবনা নেই। আকাশ ছিল সম্পূর্ণ স্বচ্ছ। সকলেই অশ্চর্যান্বিত হয়ে নিশ্বাস বন্ধ করেই যেন তাকিয়ে রইল সম্মুখ পানে অগ্রসরমান সে মেঘবৎ কৃষ্ণ ছায়াটির দিকে। ছায়াটি দৃষ্টিশক্তির আওতায় এলে দেখতে পেল যে হাজার হাজার ক্ষুদ্রাকৃতির পাখির এক বিশাল ঝাঁক। আকারে চড়ুই এর চাইতেও ছোট্ট। এ এক অভিনব দৃশ্য! দেখতে দেখতেই এ বিশাল পাখির দল শামিয়ানার মত সেনাদলকে আচ্ছাদিত করে ফেলল। আর তাদের পায়ে আকড়ে ধরা পাথর কুঁচির মত কী যেন ছেড়ে দিচ্ছে তাদের মাথার উপর। সে পাথর কুঁচি আকারে ছোট্ট ছিল বটে কিন্তু তা এত প্রচন্ড শক্তিশালী ছিল যে, তার আঘাত যার গায়েই লেগেছে তাকে ছেদ করে সমস্ত শরীরকে ঝলসিয়ে দিয়েছে এবং এতই অব্যর্থ ছিল যে সে পাথরের আঘাত থেকে কেউই রেহাই পায়নি। নিমিষের মধ্যেই আবরাহার বিশ্বাল বাহিনী ভষ্ম খড়ের স্ত্তপের মতো আবর্জনার স্ত্তপে পরিণত হয়ে গেল।
আবিসিনিয়ার সম্রাট নজ্জাশীর সেনা নায়ক ‘‘আরবাত্ব’ যিনি সম্প্রতি ইয়ামান আক্রমণ করে তা আবিসিনিয়ার করতলগত করেছিলেন এবং অত্যাচার ও নির্যাতনের স্টীম রোলারে জনগণকে নিস্পেষিত করছিলেন। জনতা তার বিরুদ্ধে একটি গণ অভ্যুত্থান পরিচালনা করে আরবাত্বকে হত্যা করত : আবরাহা নিজেই ইয়ামানের শাসন ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন।
আবরাহা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর পরিকল্পনা করলেন যে বর্তমানে মক্কা যে গোটা আরব উপদ্বীপের মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় মর্যাদা ভোগ করছে তার বিলুপ্তি ঘটিয়ে ইয়ামানকেই ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ইয়ামানের ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত অনুকুলে ছিল। কিন্তু বাধ-সাজছে আর আর একটি বস্ত্ত। তা হলো মক্কায় কা’বা গৃহের অবস্থান। যা গোটা আরব দ্বীপের বাসিন্দাদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র একটি তীর্থস্থান বলে বিবেচিত। আবরাহা চিন্তা করল এর বিকল্প কিছু করা ব্যতীত তার পরিকল্পনা সফল হওয়ার নয়। সে প্রথমে কা’বা গৃহের আকারে আকৃতি ও নির্মাণ কৌশল সম্পর্কে খবর নিল। জানতে পারল যে তা একটি সাধামাটা পাথরের ঘর বৈ কিছুই নয়। এবার আবরাহার মনে এক বুদ্ধি আটল। সে ইয়ামানে স্বর্ণ-রৌপ্য ও মূল্যবান পাথর খচিত এক অনন্য সাধারণ মন্দির প্রতিষ্ঠা করল। এবং জনগণকে এ আহবান জানাল যে, তারা যেন তার এ স্বর্ণমন্দিরকেই তীর্থস্থান জ্ঞাত করে তথায় সমবেত হয়। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এর আকর্ষণীয় সৌন্দর্য ও অভিনব নির্মাণ কৌশলের কারণে তা অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, এবং লোকেরা মক্কার সাধামাটা প্রস্তর নির্মিত কা’বাকে বর্জন করবে। তার এহেন ঔদ্ধত্যপূর্ণ পরিকল্পনা আরবের স্বাধীনচেতা লোকদের আত্মসম্মান বোধকে চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করল। তাদেরই একজন ইয়ামানে গিয়ে আবরাহা নির্মিত স্বর্ণ মন্দিরের গায়ে ময়লা মেখে এল। এতে আবরাহা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, এবং প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠলো। সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল যে, মক্কার কা’বা গৃহকে ধ্বংস না করে সে ক্ষান্ত হবেনা। সে বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলো। সে মনে মনে ভাবতে লাগল এ বিরাট বাহিনীর মোকাবিলা করার সাহস তো আরবদের সম্মিলিত শক্তির পক্ষেও নাই। তাই সে অচিরেই কা’বা গৃহকে চূর্ণবিচুর্ণ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে। আর এভাবে তার স্বর্ণমন্দিরের প্রতি তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের সমুচিত শিক্ষা দিবে। আবরাহার এ বিশাল বাহিনী মক্কার অদূরে মুযদালিফার প্রান্তরে এসে উপনীত হল। হাজার হাজার সশস্ত্র সৈন্য ও শত সহস্র হাতির বিশাল বাহিনীর আগমনের কথা শুনে মক্কার লোকদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গেল। তারা বলাবলি করতে লাগল : এ বিপদ থেকে বাঁচার তো আপাতত কোনই উপায় দেখছিনা। তবুও চল আমরা ‘আব্দুল মুত্তালিবের সাথে পরামর্শ করি। তিনি প্রখর বিচক্ষণতার অধিকারী এক ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর মধ্যে এমন অলৌকিক শক্তি আমরা দেখতে পেয়েছি যা সাধারণত অন্য কারো মধ্যে দৃষ্ট হয় না। লোকেরা যখন ‘আব্দুল মুত্তালিবের বাড়িতে পৌঁছলো তখন জানতে পারল যে আবরাহা বাহিনী তার ২০০ উট ধরে নিয়ে গেছে, তাই তিনি সে ব্যাপারে আবরাহার সাথে আলাপ করতে গেছেন।
লোকেরা একথা শুনে বলাবলি করতে লাগল : যে লোক কা’বা গৃহ ধ্বংস করার জন্য এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কার দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁছেছে তার সাথে কোনরূপ দেন দরবার যে কাজে আসবে তা কি করে আশা করা যেতে পারে?
‘আব্দুল মুত্তারিব ঠিকই আবরাহার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। হস্তী বাহিনীর প্রধান আবরাহাকে খবর দিলেন যে, কুরাইশদের সর্দার তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। ‘আব্দুল মুত্তালিবের গুণাবলীও তার কাছে তুলে ধরলেন। তিনি বললেন : ইনি আরবদের অবিসম্বাদিত নেতা, সকলের মধ্যে মর্যাদার শীর্ষে, তার দানশীলতা সর্বজন বিদিত এবং সর্বক্ষণ তার মেহমান খানার দরজা উন্মুক্ত থাকে। আবরাহা অনুমতি দিলে ‘আব্দুল মুত্তালিব তার সাথে দেখা করার জন্য তার দরবারে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ‘আব্দুল মুত্তালিবক দেখেই তিনি সম্ভ্রমে অভিভূত হয়ে পড়লেন। এবং নিজের অজ্ঞাতসারেই সিংহাসন থেকে নেমে পড়ে বিছানায় বসে গেলেন। ‘আব্দুল মুত্তালিব গিয়ে তার পাশেই বসে পড়লেন। আবরাহা জানতে চাইলেন তাঁর আগমনের প্রধান উদ্দেশ্য কি?
‘আব্দুল মুত্তালিব অত্যন্ত ধীর ও শান্ত ভাবে উত্তর দিলেন : ‘‘আপনার সেনাবাহিনীর লোকেরা আমার ২০০ উষ্ট্র রাখালদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। আমি এগুলো ফেরত চাইতে এসেছি। ‘আব্দুল মুত্তালিবের একথা শুনে আবরাহা রীতিমত আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলেন।
তিনি ভাবতে লাগলেন, কুরাইশদের সর্দার আরবদের শ্রেষ্ঠ নেতা তার কাছে এসে নিজের উষ্ট্রগুলো ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করছেন, অথচ সংকটাপন্ন কা’বা গৃহ যা ধ্বংস করার জন্য তিনি বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কার দ্বার প্রান্তে এসে উপস্থিত সে বিষয়ে কিছুই বলছেন না। তিনি চরম ঔৎসুক্যের সাথে জিজ্ঞেস করলেন : ব্যাপার কি আপনি আমাকে আপনার উষ্ট্রগুলো ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করছেন আর যে কা’বা গৃহ ধ্বংস করতে এ বিরাট বাহিনী নিয়ে এসেছি সে বিষয়ে কিছুই বলছেন না?
‘তার কথায় ‘আব্দুল মুত্তালিব মৃদু হাসি দিয়ে বললেন : ‘‘উষ্ট্রের মালিক আমি নিজেই, তাই আমি আমার সম্পদ ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আনার সাথে দেন দরবার করছি। কা’বা গৃহের একজন অধিপতি আছেন। তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তাঁরই। তিনিই তা রক্ষার ব্যবস্থা করবেন।’’
আব্দুল মুত্তালিবের এ উত্তর শুনে আবরাহা রাগান্বিত হলেন এবং বললেন : আপনি এ কি বলছেন? এর একজন অধিপতি আছেন আর তিনিই তা রক্ষা করবেন। সে মালিক কে? কে আমার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে তা আমি দেখব।’’
‘আব্দুল মুত্তালিব মক্কা উপত্যাকার বাসিন্দাদের প্রতি এ মর্মে ঘোষণা জারী করলেন যে, সবাই যেন নিজেদের ঘরবাড়ি ত্যাগ করে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করে এবং আবরাহা বাহিনীর প্রতিরোধ করার কথা চিন্তা না করে। আর তিনি নিজে কা’বা গৃহের দিকে রওয়ানা দিলেন। সেখানে গিয়ে কা’বার দরজার চৌকাঠ ধরে নিম্নোক্ত কবিতাটি পাঠ করলেন :
‘‘একজন সাধারণ লোক পর্যন্ত তার কাফেলার উপর আপতিত যে কোন বিপদের মোকাবিলা করে, কাজেই হে মহামহীম প্রভু তোমার কাফেলা আজ শত্রু কবলিত, এদেরকে রক্ষা করার দায়িত্ব তোমারই।
আমি কোন দিন শুনিনি যে কোন নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর লোক পর্যন্ত তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কথা কল্পনা করেছে। অথচ এ আবরাহা তার দেশের জনগণকে নিয়ে একটি হস্তী বাহিনী সহকারে তোমরা ঘরের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
এরা অজ্ঞতা বশত: তোমার সংরক্ষিত অঞ্চলকে পদদলিত করার ষড়যন্ত্রে মেতেছে। অথচ তোমার পরাক্রম সম্পর্কে তারা অবহিত নয়।’’
এদিকে অবরাহা পরবর্তী দিন প্রত্যুষেই তার সেনাবাহিনীকে নির্দেশ ছিল হস্তী বাহিনীকে আগ্রভাগে রেখে যেন সম্মুখে অগ্রসর হয়। যাতে করে কুরাইশের লোকেরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। হাতী গুলোকে যতই মক্কার দিকে অগ্রসর করানোর চেষ্টা করা হয় তারা এককদমও এগোয়না, এমনকি বেদম প্রহারেও না। কিন্তু অন্য যে কোন দিকে যাত্রার নির্দেশ দিলে সাথে সাথে চলা আরম্ভ করে। আবরাহাকে এ বিষয়ে অবহিত করা হলে, তিনি অনন্যোপায় হয়ে হস্তী বাহিনীর আশা ত্যাগ করে পদাতিক অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। পদাতিক বাহিনী সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে যাচ্ছিল এমন সময় দেখা গেল যে, আকাশের গায়ে মেঘমালার মত কী যেন ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। অথচ আকাশে মেঘের কোনই সম্ভাবনা নেই। আকাশ ছিল সম্পূর্ণ স্বচ্ছ। সকলেই অশ্চর্যান্বিত হয়ে নিশ্বাস বন্ধ করেই যেন তাকিয়ে রইল সম্মুখ পানে অগ্রসরমান সে মেঘবৎ কৃষ্ণ ছায়াটির দিকে। ছায়াটি দৃষ্টিশক্তির আওতায় এলে দেখতে পেল যে হাজার হাজার ক্ষুদ্রাকৃতির পাখির এক বিশাল ঝাঁক। আকারে চড়ুই এর চাইতেও ছোট্ট। এ এক অভিনব দৃশ্য! দেখতে দেখতেই এ বিশাল পাখির দল শামিয়ানার মত সেনাদলকে আচ্ছাদিত করে ফেলল। আর তাদের পায়ে আকড়ে ধরা পাথর কুঁচির মত কী যেন ছেড়ে দিচ্ছে তাদের মাথার উপর। সে পাথর কুঁচি আকারে ছোট্ট ছিল বটে কিন্তু তা এত প্রচন্ড শক্তিশালী ছিল যে, তার আঘাত যার গায়েই লেগেছে তাকে ছেদ করে সমস্ত শরীরকে ঝলসিয়ে দিয়েছে এবং এতই অব্যর্থ ছিল যে সে পাথরের আঘাত থেকে কেউই রেহাই পায়নি। নিমিষের মধ্যেই আবরাহার বিশ্বাল বাহিনী ভষ্ম খড়ের স্ত্তপের মতো আবর্জনার স্ত্তপে পরিণত হয়ে গেল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন