বাস্তবতার আলোকে তাকলীদ
বাস্তবতার আলোকে তাকলীদ
তাকলীদ একটি নিতান্তই মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায় মানুষের তাকলীদ করার প্রবনতা। মূলত তাকলীদ ছাড়া মানুষের জীবন অচল। মানুষ নিজের স্বাস্থের চিকিৎসার মত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয় যাতে তার জীবন মরণের প্রশ্ন। সেখানেও দেখা যায় ডাক্তারের তাকলীদ করে থাকে। জীবনোপকরণ তৈরির ক্ষেত্রেও তাকলীদ করে থাকে ইঞ্জিনিয়ারের। ব্যক্তিগত বা সামাজিক জীবনে তাকলীদ করতে হয় অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের। এ ক্ষেত্রগুলোতে তাদের কাছে কোন প্রমাণ চাওয়া হয় না; বরং তাদের জ্ঞানের উপর সুধারণাবশত: তাদের কথার উপর আস্থা রেখে মেনে নেয়া হয়। এসব বিষয়ে তাকলীদ কারীগণ শুধু মাত্র এতটুকু দায়িত্ব পালন করে থাকে যে, তাদের দৃষ্টিতে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি নির্বাচন করে। অবশ্য কেউ যদি অযোগ্য ব্যক্তিকে তাকলীদের জন্য নির্বাচন করে, তাহলে তা হয় নিন্দনীয়। বিষয়টি এতই স্পষ্ট যে, কেউ এতে দ্বীমত পোষণ করে না বা করার অবকাশ রাখে না। এতদ্বসত্ত্বেও বিপত্তি ঘটে কেবল দ্বীনী ও ধর্মীয় বিষয়াসয়ে। একদল লোক ধর্মীয় ব্যাপারে সব ধরণের তাকলীদের নিন্দায় লেগে আছে। মূলত এই বিরোধটির অনেকাংশই ভুল বুঝাবুঝির কারণে সৃষ্টি হয়েছে। বাসত্মবতার প্রতি লক্ষ্য করলে একথা প্রতিয়মান হয় যে, মূল ব্যত্তয়টি ঘটেছে তাকলীদকে সংজ্ঞায়িত করা নিয়ে। তাই আমার আলোচনা তাকলীদের পরিচয় ও সংজ্ঞার সাথে আবর্তিত হবে।
তাকলীদের পরিচয়:
তাকলীদের তিন ধরণের পরিচয় পাওয়া যায়। যথা-
১. তাকলীদ বিরোধিরা যে পরিচয় দিয়ে থাকে। অর্থাৎ
التقليد هو رجوع إلى قول لاحجة لقائله عليه ـ كذا فى الجامع فى طلب العلم الشريف: ৩৫০
অর্থা: তাকলীদ হল এমন বক্তব্য গ্রহণ করা, যার বক্তার এর উপর কোন প্রমাণ
নেই। তাকলীদের যত নিন্দা কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ করা হয়, সবগুলো এই পরিচয়ের
উপর ভিত্তি করে। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে,
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ
قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ
آبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ (170)
অর্থাৎ, যখন তাদেরকে বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা তোমরা অনুসরণ
করো। তারা বলে, ‘না; রবং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে যার উপর পেয়েছি তার
অনুসরণ করব। এমনকি তাদের পিতৃপুরুষগণ যদিও কোন কিছুই জ্ঞান এবং হেদায়াত
প্রাপ্ত না হয়, তথাপিও? -সূরা বাকারা: ১৭০
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ
أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا
إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ
عَمَّا يُشْرِكُونَ (31)
তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পন্ডিতগণকে ও সংসার বিরাগীগণকে তাদের প্রভূরূপে গ্রহণ করেছে।আর প্রভুরূপে গ্রহণ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে-
انهم حرموا عليهم الحلال وأحلولهم الحرام فاتبعوهم فذلك عبادتهم اياهم: تفسير ابن كثير:২/৪৫৮
অর্থ: তারা হালালকে হারাম করেছে আর হারামকে করেছে হালাল। আর অনুসারীরা
তা গ্রহণ করে নিয়েছে। এটাই হল তাদের ইবাদত করা (প্রভূরূপে গ্রহণ করা)অর্থাৎ, তারা যেভাবে নিজেদের খেয়াল খুশি মত ফতওয়া দিত অনুসারীরা সেভাবেই গ্রহণ করে নিত।
কিন্তু তাকলীদকে নিন্দা করে উদ্ধৃত এই দলীলগুলোর প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি দেই, তা হলে আমাদের কাছে প্রমাণিত হবে যে,
তাকলীদের ইত্তিবা বা ইতাআতের নিন্দায় যে সকল বর্ণনা পাওয়া যায় তার সবগুলোরই মূল কারণ হল দুটি। যথা:
ক. যাদের তাকলীদ করা হত তারা কিতাবুল্লাহকে ছেড়ে কিংবা তার স্পষ্ট বর্ণনার বিকৃত (تحريف) করে ফতওয়া দিত। যেমন-
وَمِنَ الَّذِينَ هَادُوا سَمَّاعُونَ لِلْكَذِبِ سَمَّاعُونَ
لِقَوْمٍ آخَرِينَ لَمْ يَأْتُوكَ يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ مِنْ بَعْدِ
مَوَاضِعِهِ يَقُولُونَ إِنْ أُوتِيتُمْ هَذَا فَخُذُوهُ وَإِنْ لَمْ
تُؤْتَوْهُ فَاحْذَرُوا
অর্থ: এবং ইয়াহুদীদের মধ্যে যারা অসত্য শ্রবণে তৎপর, তোমার নিকট আসে না
এমন এক ভিন্ন দলের পক্ষে যারা কান পেতে থাকে, শব্দগুলো যথাযথ সুবিন্যসত্ম
থাকার পরও তারা সেগুলোর অর্থ বিকৃত করে। তারা বলে এই প্রকার বিধান দিলে করো
এবঙ তা না দিলে বর্জন করো। সূরা মায়েদা: ৪১আয়াতটি এ অংশে তাদের ফতওয়ার ধরণ স্পষ্ট যে যদি তাদের বিকৃত বিধান পাওয়া যায় তা হলে তারা গ্রহণ করবে নতুবা নয়।
বিষয়টি এর শানে নুযূল থেকে আরোও স্পষ্ট হয়। তাফসীরে ইবনে কাসীরে বুখারী শরীফ ও মুয়াত্তা ইমাম মালিকের বরাতে উল্লেখ করেছেন-
إن اليهود جاءوا إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم الخ تفسير ابن كثير ২/৮১
عن عبد الله بن عمر رضى الله عنه أن اليهود جاءوا إلى رسول
الله صلى الله عليه وسلم فذكروا له أن رجلا منهم…… بإمرأة زنيا فقال له
رسول الله صلى الله عليه وسلم ماتجدون فى التوراة فى شأن الرجم؟ فقالوا
نفضحهم ويجلدون، قال عبد الله بن سلام: كذبتم ، إن فيها الرجم فأتوا
بالتوراة، فأتوا بالتوراة فنشروها، فوضع احدهم يده على آية الرجم، فقرأ
ماقبلها وما بعدها، فقال عبد الله بن سلام: إرفع يدك فرع يده، فإذا آية
الرجم فقالوا: صدق يا محمدا فيها آية الرجم فأمر بهما رسول الله صلى الله
عليه وسلم فرجما، فرأيت الرجل يحنى على المرأة يقيها الحجارة ـ رواه
البخارى: ২/১০১১
অর্থ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেন যে, একবার নবী কারীম সা.
এর দরবারে একদল ইয়াহুদী এসে বলল, তাদের এক পুরুষ ও এক নারী যিনা করেছে।
নবী কারীম সা. তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা রজম সম্পর্কে তাওরাতে কী পাও?
তারা বলল, আমারা তাদের লাঞ্চিত করি এবং বেত্রাঘাত করি। তখন আবদুল্লাহ ইবনে
সালাম রা. (যিনি পূর্বে বিশিষ্ট ইয়াহুদী আলিম ছিলেন) বললেন, তোমরা মিথ্যা
বলছ। নিশ্চয় তাওরাতে রজমের কথা রয়েছে। তোমরা তাওরাত নিয়ে আস! তারা তাওরাত
এনে খুলল এবং তাদের একজন তার হাত রজমের আয়াতের উপর রেখে শুধু উপর নিচে পড়তে
লাগল, তখন আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা. বললেন, তোমার হাত উঠাও! অতঃপর সে হাত
উঠালে সেখানে রজমের আয়াত দেখা গেল, তখন ইয়াহুদীরা বলল, সত্য বলেছে হে
মুহাম্মদ! সেখানে রজমের আয়াত রয়েছে। তাই রাসূল সা. সে দু’জনের ব্যাপারে
রজমের ফায়সালা করলেন এবং তাদেরকে রজম করা হয়। (সাহাবী বলেন) আমি দেখেছি
পুরুষটি নারীটিকে স্বীয় দেহ দ্বারা ঢেকে প্রসত্মরাঘাত থেকে রক্ষা করার
চেষ্টা করছিল। -বুখারী: ২/১০১১উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে তাদের তাকলীদের নিষেধাজ্ঞার কারণ স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তারা কিতাবুল্লাহর বিকৃত সাধন করে ফতওয়া দিত।
এছাড়া إتخذوا أحبارهم الخ এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইবনে কাসীর র. বলেন,
وقال السدى: إستنصحوا الرجال ونبذوا كتاب الله وراء ظهورهم ـ ابن كثير: ২/৪৫৯
তারা লোকদের থেকে উপদেশ নিত এবং কিতাবুল্লাহ পশ্চাদে নিক্ষেপ করত।-ইবনে কাসীর : ২/৪৫৯
খ. যাদের তাকলীদ বা ইত্তিবা’ করত তাদের সঠিক জ্ঞান ও হিদায়াত ছিল না। এজন্যই এই ধরনের তাকলীদকে নিন্দা করা হয়েছে। যেমন- কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ
قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ
آبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ (170)
অর্থাৎ, যখন তাদের বলা হয় আল্লাহ তা’আলা যা অবতীর্ণ করেছেন তা
তোমরা অনুসরণ করো। তারা বলে না; বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের যাতে পেয়েছি
তার অনুসরণ করব। এমনকি তাদের পিতৃপুরুষরা কোন কিছুর জ্ঞান রাখত এবং হিদায়াত
প্রাপ্ত ছিল না তথাপিও?এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তাদের পিতৃ-পুরুষেরা সঠিক পথ ও হিদায়াতপ্রাপ্ত ছিল না। আর এজন্যই তাদের অনুসরণ ও তাকলীদ নিষিদ্ধ। কিন্তু যদি তারা পথ হিদায়াতপ্রাপ্ত হতো এবং কিতাবুল্লাহর পরিবর্তন সাধন না করতো, তা হলে কখনো তাদের অনুসরণ নিন্দনীয় হতো না। যেমন নবী কারীম সা. খুলাফায়ে রাশেদীনের মত ও পথের অনুসরণ করতে বলেছেন। যারা হলেন আমাদের পূর্ব-পুরুষ। আর এটা এই জন্য যে, তারা ছিলেন হিদায়াতপ্রাপ্ত ও কিতাবুল্লাহর সংরক্ষক। মাযহাবপন্থীগণ যে ইমামগণের তাকলীদ করে থাকেন, তাদের কেউই কিতাবুল্লাহর বিকৃতি করেননি। আর তারা গোমরাহ ও পথভ্রষ্টও ছিলেন না। তাদের ব্যাপারে বড় বড় মুহাদ্দিসের প্রশংসা সুলভ বক্তব্যই এর উজ্জ্বল প্রমাণ।
২. আমরা যে তাকলীদ গ্রহণ করে থাকি তার পরিচয় হচ্ছে-
التقليد إتباع الغير على ظن أنه محق بلا نظر فى الدليل ، كذا فى حسامى فى شرح النامى : ১৯০
‘ কারো হকপন্থী হওয়ার ব্যাপারে প্রবল ধারণা থাকার ভিত্তিতে দলীল না দেখে
তার অনুসরণ করা’। এই পরিচয় প্রমাণহীন কোন বক্তব্যের বক্তার অনুসরণ
উদ্দেশ্য নয়। কারণ, প্রমাণহীন বক্তব্যের বক্তা কখনো হক হতে পারে না।এই সংজ্ঞাটিতে কয়েকটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। যার প্রতিটির উপর রয়েছে জাজল্যমান দলীল। যেমন- এই সংজ্ঞায় যে ইত্তিবার কথা বলা হয়েছে, তা সাধারণ মানুষের জন্য অত্যাবশ্যক। কারণ, কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ (59)
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য করো এবং রাসূল ও তোমাদের
মধ্যে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্তদের আনুগত্য করো। -সূরা নিসা: ৫৯এ আয়াতে أُولِي الْأَمْرِ দ্বারা উদ্দেশ্য নির্ধারণে আল্লামা ইবনে কাসীর র. হযরত ইবনে আববাস রা. থেকে তাফসীর উল্লেখ করত: বলেন,
عن إبن عباس وأولى الأمر منكم يعنى أهل
الفقه والدين وكنا قال مجاهد وعطاء والحسن البصرى وابو العالية وأولى الأمر
منكم يعنى العلماء والظاهر والله اعلم
হযরত ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, أُولِي الْأَمْرِ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ফিকহ ও দীনওয়ালা। উল্লেখ্য কেউ কেউ أُولِي الْأَمْرِ এর ব্যাখ্যায় শাসকশ্রেণিকেও অমত্মর্ভুক্ত করেছেন। সেক্ষেত্রেও উলামায়ে কেরামকে এর উদ্দেশ্য থেকে বাদ দেয়া হয়নি।আল্লামা ইবনে কাসীর তার তাফসীর গ্রন্থে বলেন,
تفسير ابن كثير২/ ৩৪৫
والظاهر – والله أعلم-أن الآية في جميع أولي الأمر من الأمراء والعلماء،
অর্থাৎ একথা স্পষ্ট যে, আয়াতটি সকল أولي الأمر অর্থাৎ শাসক ও উলামা সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। (আল্লাহ ভালো জানেন।)অপর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে,
فاسئلوا أهل الذكر إن كنتم لاتعلمون سورة النحل : ৪৩
‘তোমরা যদি না জান, তাহলে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো। -সূরা নাহল: ৪৩এধরনের তাকলীদকে আবশ্যক সাব্যসত্ম করলে একথা বলতে হয় যে, দলীল জানা সকলের উপর আবশ্যক বিষয় নয়;
বরং কিছু লোক জানবে তারা অন্যদেরকে শুধুমাত্র বিধান বলে সতর্ক করে দিবে। বক্তব্যটি অত্যমত্ম গ্রহণযোগ্য। যা কুরআনে কারীম থেকে প্রমাণিত । আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ
لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا
إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ (122)
তাদের প্রত্যেক দলের এক অংশ বাইরে বের হয় না কেন? যাতে তারা দীন
সম্বন্ধে জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে,
যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে, যাতে তারা সতর্ক হয়।এ আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে সবার জন্য দলীলে চিমত্মা-ভাবনা করা আবশ্যক নয়; বরং এ কাজের জন্য শুধু একটি নির্দিষ্ট দল থাকাই যথেষ্ট।
সবার জন্য দলীল জানা আবশ্যক না হওয়া সংক্রামত্ম প্রমাণে অনেক হাদীসও রয়েছে। যেমন-
عن أبى هريرة رضـ قال قال: رسول الله صلى الله عليه وسلم من
افتى بغير علم كان إثمه على من أفتاه ـ رواه ابو داؤد : ২/৫১৫- باب النوفى
فى الفتيا
যে ব্যক্তি ইলম ছাড়া ফতওয়া দিবে এর গোনাহ তার উপরই বর্তাবে যে ফতওয়া দিয়েছে। -আবু দাঊদ: ২/৫১৫৮যদি দলীল জিজ্ঞেস করা আবশ্যক হত, তাহলে এর গোনাহ শুধু মুফতীর না হয়ে উভয়ের হত। সুতরাং যখন শুধু মুফতীর উপর দোষারোপ করা হচ্ছে, বুঝা গেল অপর জনের দলীল না জানা দোষণীয় নয়।
এসংজ্ঞাটিতে বলা হয়েছে, যোগ্য ব্যক্তি যে মতামত পেশ করেছেন, তা হক- এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে সুক্ষ্ণ দলীল-পমাণ অনুসন্ধান না করেও তার কথা মতো আমল করা যায় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আর এর স্বপক্ষেও প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। যেমন-
عن عبد الله بن عمر رضـ قال: قيل لعمر لاتستخلف قال ان استخلف
، فقد استخلف من هو خير منى أبو بكر وان اترك فقد ترك من هو خير منى رسول
الله صلى الله عليه وسلم ـ رواه البخارى : ২/১০৭২
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত উমর রা. কে
বলা হল, আপনি কেন খলীফা বানিয়ে যান না? তিনি বললেন, যদি খলীফা বানাই তাহলে
কোন সমস্যা নেই। কেননা, আমার থেকে যিনি উত্তম আবু বকর তিনি খলীফা
বানিয়েছিলেন। পক্ষামত্মরে যদি ছেড়ে দেই, তাহলেও কোন সমস্যা নেই। কেননা,
আমার চেয়ে উত্তম ব্যক্তি নবী কারীম সা. তা ছেড়ে দিয়েছিলেন। -বুখারী: ২/১০৭২এ হাদীসে দেখা গেল, হযরত ওমর রা. হযরত আবু বকর রা.কে শুধু মাত্র হক হওয়ার উপর বিশ্বাস রেখে তার কর্মপদ্ধতির উপর আমল করদে কোনো সমস্যা নেই বলে ব্যক্ত করলেন।
إن أهل المدينة سألوا إبن عباس رضـ عن إمرأة طافت ثم حاضت ، قال لهم تنفر قالوا لانأخذ بقولك وندع قول زيد ـ رواه البخارى : ১/২৩৭
হযরত ইবনে আববাস রা. এর নিকটে মদীনা বাসীগণ সে নারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করলেন, যে তাওয়াফ করার পর ঋতুবতী হয়ে গেল। তিনি তাদেরকে বললেন, সে চলে
যাবে। তারা বলল, আমরা যায়দ বিন সাবিতের কথা ছেড়ে আপনার কথা গ্রহণ করব না।
-বুখারী: ১/২৩৭দেখুন, এই বিশুদ্ধ বর্ণনাটিতে হযরত ইবনে আববাস রা. এর বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে হযরত যায়েদ ইবনে ছাবেত রা. এর বক্তব্যকে – তিনি হক হওয়ার বিশ্বাস রেখেই বর্জন করতে অস্বীকার করে ফেললেন। এখানে মদীনাবাসীগণ কোনো দলীলে দৃষ্টি দেননি। এটা স্পষ্ট তাকলীদ ও সম্পূর্ণ التقليد الشخسى বা ব্যক্তি তাকলীদ।
তা ছাড়া দলীলে গভীর দৃষ্টি দেয়া সকলের সম্ভবও নয়। এবং সকলে দলীলের নিগুঢ় অর্থ বুঝতেও সক্ষম নয়। বিষয়টি অত্যমত্ম স্পষ্ট যার দলীলের প্রয়োজন হয় না। এতদসত্ত্বেও ব্যাপারটি প্রামাণসিদ্ধ করেই আমরা উল্লেখ করলাম। অবশ্য একটি আয়াত নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় যে,
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ} [القمر: 17]) -
কুরআনকে আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য। অতএব, উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? সূরা ক্বমার: ১৭এই আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে কুরআনে কারীম সহজ, যা সকলেই বুঝতে সক্ষম।
এর উত্তর হল, কুরআন সহজ হওয়ার অর্থ হচ্ছে, এর তিলাওয়াত ও বাহ্যিক অর্থ সহজ। কিন্তু এর আভ্যমত্মরীণ নিগুঢ় অর্থ সকলেই বুঝতে পারে না; বরং এক শ্রেণীর গভীর জ্ঞানীরাই কেবল বুঝতে পারে। তাফসীরে ইবনে কাসীরে এব্যাপারে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।
قال السدى بسرنا تلاوته على الالسن ، وقال الضحاك عن إبن
عباس: لولا أن الله يسره على لسان آميين ماإستطاع أحد من الخلق ان يتكلم
بكلام الله عز وجل ، قلت من تيسره تعالى على الناس تلاوته ـ 4/336
কুরআনের গভীর অর্থ বুঝা যদি সহজ হত, তাহলে কোন সাহাবীর তা বুঝতে ভুল হওয়ার কথা ছিল না। কারণ তারা ছিলেন আরবী এবং কুরআন তাদের মাতৃভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ বাসত্মবতা হল সাহাবায়ে কিরামেরও কখনো কখনো কুরআনের কিছু বিষয় বুঝার ক্ষেত্রে অসুবিধা হয়েছে। এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টামত্ম হল-
لكم الخيط الأبيض من الخيط الأسود ، قال أخذت عقالا أبيض
وعقالا أسود فوضعتهما تحت وسادتى فنظرت فلم أتبين فذكرت ذلك لرسول الله صلى
الله عليه وسلم فضحك فقال: إن وسادتك إذا لطويل عريض إنما هو الليل
والنهار، وقال عثمان إنما هو سواد الليل وبياض النهار ـ روه ابو داؤد :
১/৩২১
হযরত আদী ইবনে হাতিম রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যখন -حتى يتبين لكم
الخيط الأبيض من الخيط الأسود – এ আয়াতটি অবতীর্ণ হল, তখন আমি একটি সাদা
সূতা নিলাম এবং একটি কাল সূতা নিলাম। অতঃপর তা আমার বালিশের নিচে রাখলাম।
কিন্তু তা দেখে পার্থক্য করতে পারলাম না। ফলে বিষয়টি রাসূল সা. এর নিকট
বললে তিনি হেসে উঠলেন এবং বললেন, তাহলে তো তোমার বালিশটি অনেক লম্বা চওড়া।
এটাতো কেবল রাতদিন। আবু দাউদ: ১/৩২১দেখুন, কুরআনের সব অর্থ সকলের জন্য যদি বোধগম্য হতো, তা হলে এখানে সাহাবী কেন বুঝতে পারলেন না?
৩. তাকলীদের আরেকটি পরিচয় আছে যার দুটি ব্যাখ্যা করা যায়-
পরিচয়টি হল- التقليد هو قبول القول من غير دليل (كذا فى الفقيه والمتفقه للخطيب : ২/৬৬) তাকলীদ বিরোধিগণ من غير دليل এর সম্পর্ক القول এর সাথে করে থাকে, ফলে এর অর্থ দাঁড়ায়- দলীলহীন বক্তব্য গ্রহণ করা।
এ অর্থ মুতাবিক এ সংজ্ঞাটি প্রথম সংজ্ঞারই সমার্থক হয়, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ এবং আমরাও তাকলীদের এ অর্থ করি না।
আর যদি (من غير دليل) এর সম্পর্ক قبول এর সাথে করা হয়, তাহলে তা আমাদের সংজ্ঞার সমার্থক হবে, যা গ্রহণযোগ্য। তখন অর্থ দাঁড়াবে ‘কারো কথা দলীল বিহীন গ্রহণ করা’ অর্থাৎ, বাসত্মবে দলীল আছে, তবে গ্রহণ করার সময় দলীল চাওয়া হয় না।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেল যে, মাযহাবপন্থীগণ যে তাকলীদ বা ইত্তিবার কথা বলেন, তা সম্পূর্ণ কুরআন ও হাদীস মোতাবেক একটি বিষয়। যা অস্বীকার করা হটকারিতা বৈ কিছু নয়। এবং এর বিরোধীগণ যে তাকলীদের নিন্দা করে থাকে এবং তার উপর যে সকল প্রমাণাদি পেশ করে, তা মাযহাবপন্থীদের তাকলীদ থেকে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন। তাই ঐসকল দলীল দিয়ে তাদের দোষারোপ করা সম্পূর্ণই অপাত্রেরোদন। আল্লাহ তাআলা সকলকে বুঝার তাওফীক দিন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন