বর্তমান প্রেক্ষাপটে মাযহাবের অনস্বীকার্যতা
বর্তমান প্রেক্ষাপটে মাযহাবের অনস্বীকার্যতা।
ভারতবর্ষে ইসলামের সূচনাযুগ থেকে
নিয়ে বিগত শতাব্দির প্রথমার্ধ পর্যন্ত মুসলমানদের আমলী জিন্দেগী ছিল বড়ই
সৌহাদ্যপূর্ণ এবং প্রাণবন্ত। যেখানে ছিল মান্যতা, ছিল শ্রদ্ধাবোধ। নেক আমল
ও দ্বীনের পথে চলার জন্য একে অন্যের পরামর্শ ও সহযোগিতার অমলিন আচরণে হতো
সিক্ত। মোগলদের ৮শত বছর এবং পূর্বাপর সময়গুলোতে এতদঞ্চলের ধর্মপরায়ণ
সাধারণ মুসলমানরা নিজেদের জীবনকে পুরো দ্বীনের ছাঁচে গড়ার জন্য
মাযহাবপন্থি সূক্ষ্মদর্শী উলামায়ে কেরামের দ্বারস্থ হতেন। তাঁরা অক্লান্ত
মেহনত-মোজাহাদা ও সীমাহীন ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে কুরআন-সুন্নাহ-এর আলোকে
জনসাধারণকে ফেকহী সমাধান দিতেন। সাধার মানুষ এসবের উপর আমল করে তাদের আমলী
জিন্দেগীকে সুশোভিত করতেন। এটা এই অঞ্চলের মুসলমানদের হাজার বছরে ঐতিহ্য।
আলহামদুল্লিহ! এই ঐতিহ্য এখনও পর্যন্ত বজায় আছে এবং কেয়ামত অবধি বহাল
থাকবে ইনশাআল্লাহ। কারণ, এটা শুধু মুসলমানদের প্রথাগত ঐতিহ্য নয়, বরং
সাহাবায়ে কেরামের সোনালি যুগে আল্লাহ-রাসূল নির্দেশিত আর্দশের যে বিভা ছিল
তারই অপরিবর্তিত প্রতিচ্ছবি। সে আলোচনা পরে করা যাবে।
সম্প্রতি শুরু হয়েছে মুসলমানদের
এই সুন্দর ধারাবাহিক ঐতিহ্য এবং সাবলীল ও স্বাচ্ছন্দ্যময় আমলী জিন্দেগী
বিনাশের মতো অপরিণামদর্শী পাঁয়তারা। কথিত ‘আহলে হাদীস’ ছদ্মনামে গায়রে
মুকাল্লিদ লা-মাযহাবীগণ মদীনা ভার্সিটি থেকে ‘আল মাদানী’ হয়ে এসে এই
অঞ্চলের মাযহাবপন্থি বিশেষত হানাফী মাযহাব অনুসারী আহলে সুন্নাত ওয়াল
জামাতের লোকদের পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাঁধানোর অবস্থা সৃষ্টি করছে। কারো
দ্বারস্থ হওয়া নয়, কারো মতামত বা সহযোগিতা নয় প্রত্যেককেই হতে হবে
‘আহলে হাদীস’! নিত্যদিনের প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিটি জিজ্ঞাসার জবাব
ব্যক্তিমাত্রকেই সরাসরি হাদীস থেকে খুঁজে বের করে তবেই আমল করতে হবে।এমনই
উদ্ভট এবং ভয়াল এক বিতিকিচ্ছি অবস্থার জন্ম দেয়া হচ্ছে।
সঙ্গত কারণেই হকপন্থি উলাময়ে
কেরাম ইলেকট্রিক মিডিয়ার প্রতি সর্বদাই অনীহ ছিলেন। ছিদ্র-সন্ধানী আহলে
হাদীসরা এই সুযোগটাকে মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে। যাদের ইলম এবং
শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা যায় প্রচুর। যারা জনবিচ্ছিন্ন এবং
নিতান্ত অখ্যাত সেই লোকগুলো মিডিয়ার সুযোগে মুসলমানদের মাঝে অনৈক্য এবং
বিভ্রান্তির তিক্ত বাষ্প ছড়াচ্ছে। মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী
আল আযহারীর ভাষায় “মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে আসা অনেক
পরিচিত বন্ধু-বান্ধবকে যাদেরকে ইতোপূর্বে আমরা অনেক আশার দৃষ্টিতে দেখতাম
লক্ষ করলাম, ঢাকায় ফিরে তাঁরা একান্তই জড়বাদী চিন্তা-চেতনার পরিচয়
দিচ্ছেন। কোথায় বাড়ি কিনবেন, কোথায় দোকান করবেন এগুলোই যেন তাদের
চিন্তার কেন্দ্র। জাতীয় প্রয়োজন, ইসলামের প্রয়োজনে এখানে কী করণীয় তা
নিয়ে তাদের মধ্যে কোনোই মাথাব্যাথা দেখা গেল না।… হ্যাঁ, দু’চারজন অনেক
চেষ্টা-তদবির করে মুবাল্লিগের চাকরি জুটিয়ে বিনা তাবলিগেই সৌদি বেতন-ভাতা
গুণতে লাগলেন। তাও আবার মওদুদী চিন্তাধারার বা তথাকথিত সালাফী না হলে সে
চাকরি পাওয়া বা রক্ষা করা দুরূহ। তাদের খেদমত বা করণীয় অশিক্ষা,
কুশিক্ষা, নাস্তিকতা, দুর্নীতি বা হাজার হাজার বিদেশি সাহায্য প্রতিষ্ঠান
এনজিও) কর্তৃক এদেশের ধর্ম ও সভ্যতা বিনাশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নয়। তাদের
সংগ্রাম ও সব সাধ্য-সাধনা এ দেশ থেকে হানাফী মাযহাব দূর করে কীভাবে
‘সালাফিয়্যাত’ তথা গয়রে মুকাল্লিদ একটা সৌদি তল্পিবাহী সমাজ গড়ে তোলা
যায়।
উপমহাদেশে হানাফী মতাদর্শের
মশালটা যেহেতু দেওবন্দী উলামায়ে কেরামের হাতে, আর তাঁদেরই সমর্থিত
বিশ্বব্যাপী সফলতম ইসলামী প্রচারমিশন তাবলীগী জামাত যেহেতু কোটি কোটি
মানুষের মনে দাগ কাটছে, দিন দিন পত্রপল্লবে সুশোভিত হচ্ছে তাই, তাদের মতে এ
শিবিরটাকে যেমন করেই হোক তছনছ করে দিতে হবে। এজন্য সৌদি ‘সালাফী’ ‘জামাতী’
মুবাল্লিগণ আদাজল খেয়ে লেগেছেন। তাঁরা এখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও
তথাকথিত সালাফীদের গায়রে মুকাল্লিদ চিন্তাধারা এবং সালাফী লেখক আলবানির
নামায শিক্ষাদানের অভিযানে নেমেছেন। হিদায়া, আলমগীরী, বাহরুর রায়েক, শরহে
বেকায়া, বেহেশতী যেওর, রাহে নাজাত, মিফতাহুল জান্নাত নয় এখন সব
রেফারেন্সের জন্য নাসিরুদ্দিন আলবানির পুস্তকাদিই পাঠক ও শ্রোতাদের সামনে
তুলে ধরতে হবে। সবাইকে সালাফী বানাতে হবে।”
এই অশুভ শক্তির বীজকে পরিণতিতে
পৌঁছতে দেওয়া যায় না। উলামায়ে কেরামকে আজ খুব বেশি করে ভাবতে হবে। কারণ,
মাযহাবমানা যদি শিরক হয়, ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতো ভুবনবিখ্যাত
মুজতাহিদ ইমাম যাঁর করুণার বারিধারায় কথিত আহলে হাদীসরাও অবগাহন করে ফিরে
সদা-সর্বদা তিনি যদি ‘কাফের’ হয়ে যান তাহলে তো আমাদের দ্বীন- ঈমান সবই
ভূলুণ্ঠিত হয়ে যাবে!
মাযহাবের স্বরূপ, এর
অনস্বীকার্যতা এবং অনুসরণীয় সোনালি যুগে এর ব্যাপক উপস্থিতির আলোচনা চরম
গৌণ, অপাঙক্তেয় এবং বাহুল্য হলেও আজকের প্রেক্ষাপটে তা বারংবার অবতারণার
দাবি রাখে। কারণ, একগেঁয়ে এবং গোয়ের্তুমি প্রকৃতির মানুষদের জন্য এটাই
একমাত্র প্রতিষেধক। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধটি সেই প্রণোদনা থেকেই লেখা।
তাকলীদ বা মাযহাবের স্বরূপ :
একথা সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, মৌলিক অনুসরণ এবং আনুগত্য কেবলই আল্লাহ
এবং তাঁর রাসূল সা.-এর প্রতিই থাকতে হবে। আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসূল
সা.-এর প্রতিটি নির্দেশ এবং বিধান পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের মাঝে সুস্পষ্ট
কিংবা ইঙ্গিতার্থকরূপে বিদ্যমান রয়েছে। যদি কুরআন-হাদীসে সুস্পষ্ট অর্থে
কোনো ‘হুকুম’ পাওয়া যায় এবং বাহ্যিক অর্থ ছাড়া অন্য কোনো অর্থের
সম্ভাবনা না থাকে এবং কুরআন হাদীসের কোথাও ঐ হুকুমের খেলাফ কোনো বক্তব্য না
থাকে তাহলে সকল মাযহাবের ইমামগণের মত হলো, নির্দিষ্ট ঐ হুকুমের উপরই আমল
করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটানো চলবে না। এই মাসআলায় ইজতেহাদ কিংবা কারো
অনুকরণ-অনুসরণের বিন্দু-বিসর্গমাত্র সুযোগ নেই। যেমন, নামায ফরজ কিনা এ
ব্যাপারে কোনো ইমামের মতামত নেওয়া বা দেওয়ার কোনোই দরকার নেই। ঠিক কেউ
যদি বলে, নামায পড়া লাগবে না তাহলে তার কথাও শোনার কোনো প্রয়োজন নেই।
কারণ, কুরআন-হাদীসে সুস্পষ্ট করণীয় এ ব্যাপারে বিবৃত আছে। সুদ বৈধ না অবৈধ
এ ব্যাপারে গবেষণার কোনো মানে নেই। কারণ, তা যে হারাম এ ব্যাপারে পরিষ্কার
বক্তব্য কুরআন-হাদীসে ব্যক্ত হয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে ইজতেহাদ বা গবেষণার
যেমন প্রয়োজন নেই তেমনি অন্য কারো অনুসরণও বৈধ নয়।
কিন্তু কুরআন এবং হাদীসে এমন
অনেক বিধানাবলি রয়েছে যেগুলোতে কিছু সংক্ষিপ্ততা এবং অস্পষ্টতা বিদ্যমান।
অথবা একাধিক অর্থের অবকাশ আছে কিংবা কুরআন হাদীসেরই অন্যত্র তার বিপরীতমুখী
বিধান বাহ্যত দৃষ্টিগোচর হয় সে ক্ষেত্রে আমল করার দুটি মাত্র পথ খোলা আছে
১. কোনো ব্যক্তি নিজের ইলমী
যোগ্যতা ও শক্তিশালী প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে চূড়ান্ত চেষ্টা-সাধনার
মাধ্যমে শরীয়তের ‘উদ্দিষ্ট বস্তু’ বোঝার চেষ্টা করা
২. ব্যক্তি নিজে কুরআন-হাদীসের
তথ্যের উদ্দেশ্য অর্জন এবং অনুসন্ধান করবে না বরং একজন নির্ভরযোগ্য এবং
নিজের থেকে বেশি অভিজ্ঞ ব্যক্তির দ্বারস্থ হবে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ
করেছেন- ‘তোমরা আহলে ইলমের কাছে জিজ্ঞাসা করো, যদি তোমরা না জানো।’ আর
আহলে ইলমের কাছে জিজ্ঞাসা করে আমল করা এবং তার অনুসরণ করাই হলো তাকলীদ। এরই
নাম মাযহাব। এর বেশি তো কিছু নয়।
হাদীস, আহলে হাদীস ও বাস্তবতা :
গায়রে মুকাল্লিদ বন্ধুরা নিজেদেরকে ‘আহলে হাদীস’ বলে থাকেন। যার মর্ম
তাঁদের কাছে এই যে, হাদীসের ইলমও তাঁদের কাছেই আছে এবং হাদীসের উপর আমলও
তাঁরাই করে থাকেন। যারা মাযহাব মানেন তাদের কাছে না আছে হাদীস এবং না তারা
হাদীসের উপর আমল করেন!
বস্তুত আহলে হাদীসদের এই ধারণার
ভিত্তি হলো আত্মস্বীকৃতি এবং আত্মপ্রবঞ্চনার উপর। যার বাস্তবতা হলো যোজন
যোজন দূরে। প্রকৃত সত্য হলো, হাদীস শাস্ত্রের সাথে তাঁদের দূরতম সম্পর্কও
অনুপস্থিত। শুধুমাত্র কতিপয় বিরোধপূর্ণ মাসায়েল চর্চায় নিবৃত থেকেই তারা
মুহাদ্দিস বনে গেলেন! হাদীসের উপর আমলকারী হয়ে গেলেন!
আর এ কারণেই নিত্য নতুন আবিকৃত
মাসায়েলের বিধান সংশ্লিষ্ট হাদীস যখন তাদের কাছে জিজ্ঞেস করা হয় তখন
তাঁরা হাতযুগল বগলদাবা করে চিন্তার সাগরে মুষড়ে পড়েন। এবং ঐ সকল
ব্যক্তিদের কিতাবাদিই ঘাটতে থাকেন যাদেরকে ‘মুশরিক’ বলতেও পরিশ্রান্ত হন
না। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে বাস্তবতা বোঝার এবং আমল করার হিম্মত, শক্তি এবং
তাওফীক দান করুন। আমীন!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন